লিগ্যাল এইড : ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু

মোঃ আক্তার হোসেন : যে কোন সামাজিক ব্যবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়া খুবই গুরুত্বপ‚র্ণ একটি বিষয়। আইনের শাসন মানেই আইনের চোখে সবাই সমান। কেউ গরিব বা ধনী হোক, তার অধিকার রয়েছে ন্যায়বিচার পাওয়ার। আইনের সুযোগ সুবিধা কেবল ধনী লোকজন ভোগ করলে, সমাজে বৈষম্য তৈরি হতে বাধ্য। এজন্য দরিদ্র মানুষদের আইনি সহায়তা দরকার হয়। লিগাল এইডের মাধ্যমে গরিব ও অসহায় মানুষেরাও তাদের সমস্যা নিয়ে আদালতে যেতে পারে এবং ন্যায্য বিচার চাইতে পারে। এটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার একটি বড় মাধ্যম। বাংলাদেশের মতো দেশে লিগাল এইডকে সরকার একটি দায়িত্ব মনে করে। অনেকেই আছেন, যারা আইনজীবীর খরচ চালাতে পারেন না। এই কারণে তারা আইনগত অনেক সমস্যায় দিশা খুঁজে পায় না। লিগাল এইড এই সমস্যা দ‚র করতে সাহায্য করে। গরিব, প্রান্তিক, অথবা সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষ যেন বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটা নিশ্চিত করাই এর লক্ষ্য। এই সহায়তা মানুষকে সাহস দেয় তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে, আদালতে যেতে এবং ন্যায্যতা দাবি করতে। আইনি ব্যবস্থা কেবল ধনীদের জন্য নয়, এটা সবার জন্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে যে, সব নাগরিক সমান। সংবিধানের ১৯(১) ও ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, আইনের সামনে সবাই সমান। কারো অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে তাকে বিচার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই নীতিগুলো মানলে সমাজে সমতা আসে। গরিবদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের জন্য আইনি সহায়তা দিলে সমাজ আরও ন্যায়ভিত্তিক হয়। লিগাল এইড তাই কেবল আইনি প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি মানবাধিকার।
লিগাল এইডের মাধ্যমে মানুষ আইনি সাহায্য পায় যেমন ফৌজদারি মামলায়, পারিবারিক বিরোধে, জমি সংক্রান্ত ঝামেলায়, অথবা সরকারি সেবা নিয়ে সমস্যায়। অনেকেই আছেন গৃহহীন, প্রতিবন্ধী, অথবা নির্যাতনের শিকার। তারা আইনি সহায়তাটুকু পেলে তাদের কষ্টের কথা বলতে পারেন এবং তাদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির পথ সুগম হয়। একজন দরিদ্র নারী যদি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন, তিনি যদি আইনি সাহায্য না পান, তাহলে তিনি ন্যায্য বিচার পাবেন না। এই কারণেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য লিগাল এইড সার্ভিস দরকার। জাতীয় আইনি সহায়তা পরিষেবা সংস্থা (ঘখঅঝঙ) বাংলাদেশে এই কাজটি করে। তারা গরিবদের আইনি সহায়তা দেয়, যাতে তারা আইনজীবী ছাড়াও তাদের কথা আদালতে বলতে পারেন। এই সহায়তা পাবার জন্য দরিদ্র মানুষকে কেবল একটি আবেদন করতে হয়। তারপর তাদেরকে একজন আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে সাহায্য করা হয়। এই সেবাগুলো একদম বিনামূল্যে দেওয়া হয়। যখন আইনি ব্যবস্থা কেবল ধনীদের জন্য কাজ করে, তখন সেটা পক্ষপাতম‚লক হয়ে যায়। এতে গরিব মানুষরা তাদের অধিকার হারায়। সমাজে তখন আইনের উপর মানুষের আস্থা কমে যায়। কেবল যদি ধনীরা ভালো আইনজীবী নিয়োগ দিয়ে অনেকটা একতরফা বিচার পেয়ে যায়, তাহলে নির্ধনরা পিছিয়ে পড়ে। এতে সামাজিক অবিচার ঘটে। লিগাল এইড এই সমস্যা কাটাতে সাহায্য করে। এটা নিশ্চিত করে যে আইনের শাসন শুধু কিছু ধনী মানুষের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। আইনি সহায়তা শুধু অপরাধের মামলায় দরকার হয় না। অনেকে পারিবারিক বিরোধ, জমি বা বাড়ি নিয়ে বিরোধ, অথবা সরকারি সুবিধা পেতে গিয়ে সমস্যা মোকাবেলা করেন। এসব ক্ষেত্রেও লিগাল এইড দরকার। যেমন, একজন মা যদি সন্তানের হেফাজত চান এবং তিনি দরিদ্র হন, তাহলে তার পক্ষে আদালতে মামলা করা কঠিন হতে পারে। সে যদি লিগাল এইড পায়, তাহলে সে ন্যায্যভাবে তার সন্তানের হেফাজত চাইতে পারে। একইভাবে, কেউ যদি বাসা থেকে উচ্ছেদের মুখোমুখি হন, যদি তিনি লিগাল এইড পান, তিনি নিজের পক্ষে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। অনেক দেশেই লিগাল এইড আছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশ গরিব মানুষদের জন্য এই ব্যবস্থা রেখেছে। এতে দরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যে, তারাও এ সমাজের অংশ এবং তাদেরও অধিকার আছে। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাটি শক্তিশালী হলে, দরিদ্র মানুষদের জন্য বড় উপকার হবে। তখন দরিদ্র মানুষ আরও সাহস পাবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে। আইনি সহায়তা থাকা মানে হলো, কেউ আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও তারা ন্যায়বিচার পেতে পারে। একটি ভালো সমাজ গঠনের জন্য লিগাল এইড অনেক গুরুত্বপ‚র্ণ। এটি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের আইনের ছায়ায় নিয়ে আসে। যখন সবাই সমান সুযোগ পায়, তখন সমাজে ন্যায্যতা বজায় থাকে। আদালত কেবল ধনীদের জায়গা হয় না, বরং সবার জায়গা হয়। লিগাল এইড নিশ্চিত করতে চায় যে, কেউ কেবল টাকার অভাবে বিচার থেকে বঞ্চিত হবে না। আইনি সহায়তা পাওয়া কোনো বিলাসিতা নয়, এটি একটি মৌলিক অধিকার। প্রতিটি মানুষ আইনের দৃষ্টিতে সমান, লিগাল এইড সেই অধিকার বাস্তবায়ন করে। এটি দরিদ্রদের কণ্ঠ তোলার সুযোগ করে দেয়, তাদের সুরক্ষা দেয়, এবং ন্যায্যতা পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা আরও সহজ, দ্রæত ও কার্যকর হলে সমাজে আরও সাম্য এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে।
পরিশেষে বলা যায়, লিগাল এইড সমাজের জন্য একটি অতি জরুরি ব্যবস্থা। এটি সমাজের দুর্বল মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাদের কথা শুনে এবং তাদের অধিকার রক্ষা করে। এটি বিচার ব্যবস্থাকে সবার জন্য উন্মুক্ত করে তোলে। এই কারণে, সরকার ও সমাজের সবার উচিত লিগাল এইডকে গুরুত্ব দেওয়া। যখন একজন দরিদ্র মানুষও তার ন্যায্য অধিকার পায়, তখনই সমাজ সত্যিকার অর্থে ন্যায়ভিত্তিক হয়। তাই লিগাল এইড থাকা উচিত সমাজের প্রতিটি নাগরিকের জন্য, যেন তারা বিচার পাওয়ার প‚র্ণ সুযোগ পায়, যেমনটি সংবিধানে বলা হয়েছে- সমতা, ন্যায্যতা এবং ন্যায়বিচার সবার জন্য।
লেখক : মোঃ আক্তার হোসেন
চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কক্সবাজার।


আপনার মতামত লিখুন